১৯ মে : মাতৃভাষার নামে শপথ নেওয়ার দিন
তমোজিৎ সাহা
১৯ মে ১৯৬১। ভাষা শহিদের রক্তে রাঙানো একটি ঐতিহাসিক দিন। মাতৃভাষা বাংলাকে ভালোবেসে ভাষার স্বাধিকার, আত্মপরিচয়, শিক্ষা এবং চর্চার অধিকার রক্ষার জন্য শিলচর রেলস্টেশনে পুলিশের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন এগারোজন ভাষাসেনানী।
কিন্তু ষাট বছর আগে কেন এমন একটি নৃশংস ঘটনা ঘটেছিল? এর পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং আসামের কুটিল আধিপত্যবাদী ভাষা-রাজনীতি। আমাদের কাছাড় চিরকাল থেকেই অখণ্ড বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অংশ ছিল। মধ্যযুগে কাছাড়ের ডিমাসা রাজার রাজভাষা ছিল বাংলা। ডিমাসা রাজারা বাংলা ভাষাতেই রাজকার্য পরিচালনা করতেন এবং সঙ্গে কাব্যচর্চাও করতেন, সেসব প্রচুর প্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। আমাদের কাছাড় বা বর্তমান বরাক উপত্যকা কখনোই আহোম রাজ্যের অধীন ছিল না। এখানে কখনোই অসমিয়ার বসবাসও ছিল না। ব্রিটিশ আসার পর দীর্ঘদিন আসামের সরকারি ভাষা ছিল বাংলা। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ যখন কাছাড়, শ্রীহট্ট এবং গোয়ালপাড়াকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে তখন থেকেই আমাদের দুর্ভাগ্যের সূত্রপাত। তখন আসাম দুটো ভাগে বিভক্ত ছিল — সুরমা উপত্যকা ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা। সুরমা উপত্যকার সদর শহর ছিল শিলচর। ১৯৩১ সালের জনগণনার হিসাবে সংখ্যার বিচারে আসামে বাঙালি ছিল অসমিয়াদের দ্বিগুণ। উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকরা কিছুতেই বাঙালির এই মর্যাদা মানতে পারছিল না। তারা নানা কুটিল জাল বিস্তার করল। ফলে হল দেশভাগ। দেশভাগের ফলে কাছাড় (হাইলাকান্দি সহ), করিমগঞ্জ এবং গোয়ালপাড়া থেকে গেল ভারতের আসামে, আর তিনটি থানা ছাড়া সিলেট চলে গেল পূর্ব পাকিস্তানে। অসংখ্য বাঙালি শরণার্থী আসামে এসে আশ্রয় নিলেন। তারপরেও সংখ্যার কারচুপিতে ১৯৫১ সালে বাঙালির সংখ্যা এসে দাঁড়াল তিনভাগের একভাগ আর অসমিয়াভাষীর সংখ্যা বেড়ে গেল আড়াই গুণ!
আসামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী স্বাধীনতার পরেই ঘোষণা করলেন, আসাম শুধু অসমিয়াদের জন্য। মহাত্মা গান্ধী এর তীব্র বিরোধিতা করে বলেন– যদি তাই হয়, তবে ভারতবর্ষ কার জন্য? ফলে স্বাধীনতার পর থেকেই আসামের শাসক উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে বাঙালি সহ অন্যান্য ভাষিক সংখ্যালঘুর সমস্ত অধিকার কেড়ে নেবার বা তাড়িয়ে দেবার চক্রান্ত করে গেছে। তাই দেখা গেল পঞ্চাশের দশকে বঙাল খেদা আন্দোলনের নামে ভ্রাতৃঘাতী হিংসার আগুনে আসাম জ্বলে উঠল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বহুভাষিক আসামের সমস্ত ভাষিক সংখ্যালঘুর মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নেবার জন্য ১৯৬০ সালে আসাম বিধানসভায় এল রাজ্যভাষা বিল। যেখানে অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার প্রস্তাব করা হল। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে গর্জে উঠল বরাক উপত্যকা। শুরু হল আন্দোলন। বরাকের বাঙালির নেতৃত্বে আসামের অন্যান্য ভাষিক সম্প্রদায়ের মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতির এই আগ্রাসন কেউ মেনে নিতে পারলেন না। কারণ বহুভাষিক স্বাধীন ভারতের সংবিধান আমাদের সকলকে নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চার সুরক্ষিত অধিকার প্রদান করেছে। এই অবস্হায় দাবি উঠল আসামের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা বাংলাকে সমান মর্যাদা দিয়ে দ্বিতীয় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। বরাকের বিধায়ক সহ জনতার কোনো প্রতিবাদের পরোয়া না করে বিধানসভায় অসমিয়াকে রাজ্যভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হল। গণদাবিকে উপেক্ষা করার ফলে আন্দোলন আরও তীব্রতর হল।

১৯৬০ সালের শেষে করিমগঞ্জে গঠিত হয় কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ। এই গণসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সমস্ত বরাকের গ্রামেগঞ্জে, স্কুল-কলেজে ছড়িয়ে পড়ে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের বার্তা। সকলের সামনে প্রেরণাস্বরূপ ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঢাকায় বাংলা ভাষার জন্য আত্মবলিদানের মহৎ সংগ্রামী আদর্শ। অবশেষে এল ঐতিহাসিক ১৯ মে। সেদিন কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ বরাকের সর্বত্র সর্বাত্মক হরতালের ডাক দিয়েছিল। হাজার হাজার সত্যাগ্রহী ভোর থেকে মাতৃভাষার দাবিতে হরতাল সফল করবেন বলে পথে নামেন। সকাল থেকেই পুলিশ হাজার হাজার সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করেও আন্দোলন থামাতে পারেনি। ‘বাংলাভাষা জিন্দাবাদ, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘বন্দেমাতরম’ শ্লোগানে শান্তিপূর্ণ জনতা সকাল থেকেই শিলচর রেলস্টেশনে রেললাইন কামড়ে পড়ে আছে। আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীর অধিকাংশই স্কু্ল-কলেজের ছাত্রছাত্রী। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য তাদের আবেগ এবং শপথ সরকারকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কারণ তাঁরা জানতেন মাতৃভাষা ছাড়া কোনও জাতির আত্মপরিচয়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
দুপুর ২:৩৫ মিনিটে অতর্কিতে শান্তিপূর্ণ নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালাল। সঙ্গে সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়ে রেললাইনে লুটিয়ে পড়লেন ভাষা সংগ্রামীরা। আহত হলেন অনেকে। প্রাণ হারালেন ১১ জন। তাঁরাই আমাদের অমর একাদশ ভাষা শহিদ। পরদিন কার্ফুর মধ্যেই শহিদের মরদেহ নিয়ে শিলচরে হাজার হাজার জনতার বিশাল শোকমিছিল বের হয়। সবাই শপথ নেন শহিদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেবেন না। মাতৃভাষার অধিকার ছিনিয়ে নেবেনই নেবেন। সারা দেশে এই ঘটনা তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করল।কলকাতার সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় পরপর শহিদদের ও ভাষা সংগ্রামের সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠে। রক্ত দিয়ে যাঁরা মাতৃভাষার ঋণ শোধ করে গেলেন সেই অমর শহিদরা হলেন — কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, তরণীমোহন দেবনাথ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্র দেব, সুনীল সরকার, কানাইলাল নিয়োগী এবং সুকোমল পুরকায়স্হ।

উল্লেখ্য, শহিদ কমলা সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাভাষার জন্য বরাকের বাঙালির কঠোর আন্দোলন এবং শহিদের আত্মবলিদানের ফলে ১৯৬১ সালে আসাম সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং বরাক উপত্যকায় সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। যদিও শাসকের অসমিয়াকরণের অপচেষ্টা কিন্তু থামেনি।
পুনরায় ১৯৭২ সালে এবং ১৯৮৬ সালে ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে আরও তিনজনকে শহিদের মৃত্যুবরণ করতে হয়। তাঁরা হলেন — বিজন চক্রবর্তী, জগন্ময় দেব এবং দিব্যেন্দু দাস। সেইসঙ্গে ১৯৯৬ সালের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা শহিদ সুদেষ্ণা সিনহার কথাও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ভাষা শহিদের এই ইতিহাসের ধারা আসলে একটি সুতোয় গাঁথা। কোনোকিছুর মূল্যে মাতৃভাষার অধিকার বিসর্জন দেওয়া যায় না। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষাকারী বরাকবাসীর কাছে ভাষা আন্দোলন আসলে বহমান ইতিহাসের পুনঃ পুনঃ পরীক্ষার নাম। ১৯ মে তাই আজকের পৃথিবীর কাছে মাতৃভাষার নামে শপথ নেবার দিন। কুচক্রী যারা আজও আমাদের মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে চেতনাকে শান দেবার দিন। বরাকের বাঙালি বাংলাভাষা চর্চার অধিকার শুধুমাত্র জন্মসূত্রে লাভ করেনি, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণপ্রিয় ভাষার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তাই আমাদের চেতনায় এবং সময়ের বুকে উনিশের ভাষা শহিদরা চির জাগ্রত। ###
আরো দেখুন : চিরাঙের যুবকের বিরল প্রতিভা, মুখ দিয়ে আঁকল মুখ্যমন্ত্রীর অসাধারণ ছবি