মনোজ মোহান্তি, নিভিয়াঃ ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস।’ কবিগুরুর কবিতার এই পংক্তিটি যেন দক্ষিণ রাতাবাড়ির সিংলা নদীর পশ্চিম পারের গ্রামগুলির মানুষের বর্তমান বাস্তবিকতাই ব্যক্ত করছে। খরস্রোতা সিংলা নদী রাতাবাড়ি কেন্দ্রের মধ্য ভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গিয়েছে। ফলে পুরো এলাকা প্রায় দু ভাগে বিভক্ত। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের দুল্লভছড়া থেকে শুরু করে রংপুর পর্যন্ত নদীর পশ্চিম পারের শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা আজও সেই আদিম যুগের । তবে নদীর পূর্ব পারে দুল্লভছড়া থেকে রংপুর পর্যন্ত রয়েছে পাকা সড়ক। ফলে বৃষ্টির মরশুমে গ্রামের কর্দমাক্ত সড়ক দিয়ে কিলোমিটার পর কিলোমিটার পথ হেঁটে নৌকা বা বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে যানবাহনের দেখা পান ওই সব গ্রামের মানুষ। বিগত প্রায় দেড়শো বছরের ও অধিক কাল হতে শিংলাছড়া গাঁও পঞ্চায়েতের ওয়াঙ্গিরবন্দ নোনিয়াটিলা বেরঙ্গা আবাদিবস্তি পালটিলা সকলপুর ইত্যাদি প্রায় ২৫টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন নিভিয়া শ্মশান ঘাটের পাশে সিংলা নদীতে তৈরি বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পারাপার করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী যাতায়াত করতে বাধ্য। বৃস্টির মরশুমে খরস্রোতা সিংলার প্রবাহে সাঁকো ভেসে যাওয়ার পর ডিঙি নৌকাই একমাত্র সম্বল। এতে শত শত স্কুল কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে গ্রামগুলির হাজার হাজার মানুষকে প্রতিদিনই চরম কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। মুমুর্ষ রোগী কিংবা গর্ভবতী মহিলাদের চ্যাংদোলা করে ওপারের কয়েক কি.মি কর্দমাক্ত সড়ক অতিক্রম করার পর সাঁকো কিংবা নৌকা যোগে নদী পার করাতে হয়। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার গৃহ নির্মাণের সামগ্রী নদী পার করে বাড়ি পৌছাতে বহন খরচে ব্যয় হয়ে যায় চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা। এতে অধরা থেকে যায় ঐ সব গ্রামের হিতাধিকারী দরিদ্র পরিবারের পাকা ঘরের স্বপ্ন। ফলে জনগণ বারবার দাবি জানানো সত্ত্বেও আজ অবধি সেখানে পাকা সেতুর নির্মাণ আর হয়নি।

পরিতাপের বিষয়, যে ঘাটে নৌকা বা বাশেঁর সাঁকো দিয়ে প্রায় পঁচিশটি গ্রামের মানুষ প্রতিদিন পারাপার হন, সেই ঘাটের অপর প্রান্তে সিংলানদীর পাশে পূর্ত সড়কের লাগোয়া একটি মাঠ রয়েছে। ঐ মাঠে বিগত দিনে বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারে রাজ্যের তাবড় তাবড় নেতারা হেলিকপ্টারে অবতারণ করে প্রতিশ্রুতির বহু ফুলঝুরি ছুটিয়ে গেছেন। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালকে ধরে বর্তমান পূর্ত মন্ত্রী তথা রাজ্যের সেকেন্ড ইন কমান্ড ডঃ হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সহ বিজেপির স্টার প্রচারক মনোজ তিওয়ারি ও নদীতীরের ঐ মাঠে নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিয়ে পাকা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন।
অনুরূপ ভাবে কংগ্রেসের জমানায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ও সোনার রাতাবাড়ির স্বপ্ন দেখিয়ে বর্তমান সাংসদ কৃপানাথ মালাহকে রাতাবাড়ি সমষ্টি হতে প্রথমবারের মতো জিতিয়ে বিধানসভায় বসিয়ে ছিলেন। তারপর তিনি দ্বিতীয়বার ও কংগ্রেসের মনোনয়নে জয়ী হয়ে বিধায়ক নির্বাচিত হন। পরবর্তী তে কৃপানাথ মালাহ বিসংবাদী নেতা ডঃ হিমন্ত বিশ্ব শর্মার হাত ধরে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। এতে ২০১৬ র নির্বাচনে রাতাবাড়িতে মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের টোপ দিয়ে বর্তমান স্বাস্থ্য মন্ত্রী উনাকে প্রথমে রাতাবাড়ির বিধায়ক ও পরবর্তীতে করিমগঞ্জের সাংসদ পদে নির্বাচিত করিয়ে নিয়ে যান। ফলে ২০১৯ এ রাতাবাড়িতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ উপনির্বাচনে ডঃ শর্মা রাতাবাড়িতে ঘাঁটি গড়ে বসে বিজয় মালাকার কে জিতিয়ে নিয়ে যান। প্রতিটি নির্বাচনের সাক্ষী হয়ে থাকে সিংলানদীর তীরে অবস্থিত নিভিয়া শ্মশান কালীমন্দিরের লাগোয়া ঐ খেলার মাঠ।

কিন্তু স্বাধীনতার সত্তর বছরপর ও ঐ মাঠ সংলগ্ন নদীঘাটে একটি পাকা সেতুর নির্মাণ আর হয়ে ওঠেনি । ফলে বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতেও সেই আদিম যুগের যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে বসবাস করতে হচ্ছে নদীর পশ্চিম পারের প্রায় পঁচিশটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ কে। তাই আগামী শুক্রবার পূর্ত মন্ত্রীর রাতাবাড়ি সমষ্টির রামকৃষ্ণ নগর সফর কালে সিংলানদীর উপর পাঁচটি পাকা সেতু নির্মাণের উনার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে সাংসদ কৃপানাথ মালা ও বিধায়ক বিজয় মালাকারের কাছে জোরালো দাবি জানিয়েছেন ওই সব গ্রামের ভুক্তভোগী মানুষ।