বিদিশা রায়চৌধুরী
আমার নাম দুর্গা। শুধু দুর্গা। কোনো উপাধি ব্যবহার করার প্রয়োজন এখন আমি আর বোধ করিনা। আমি নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট। কেন? এই ইতিহাস বলার জন্যই আজ কলম তুলে ধরেছি…
পশ্চিমবংগের এক ছোট গ্রামে আমার জন্ম। আমি, আমার ভাই আর মা-বাবা। ছোট ও সুখী পরিবার ছিলাম আমরা। কিন্তু, “সুখী” হওয়ার ডেফিনেশনটা ছোটবেলা থেকেই তিলে তিলে বদলে গেছিল আমার কাছে। আমাদের গ্রামে বাবার একটা কাপড়ের দোকান ছিল। সংসারে অভাব না থাকলেও, “অভাব” কী জিনিস তা আমি ছোট থেকেই জানি। কারণ আমায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন নাকি আমার জন্ম। তাই মা নাম দিয়েছিলেন দুর্গা। কিন্তু আরও দশজন মায়ের মতোই আমার মা-ও আমায় লক্ষীটি, মা, সোনা ইত্যাদি বলে ডাকতেন। ঠিক যেমন আমার ভাইকে ডাকতেন। কিন্তু বাবা কখনও আমাকে আদর করতেন না। এমনকি প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলতেন না। আর আদর করে নাম দেওয়া তো দূরে থাক। যখনি আমি বাবার কাছে যেতাম, তিনি আমায় দূরে ঠেলে দিতেন। অথচ ভাই ছিল তাঁর চোখের মণি। ভাইয়ের সাত খুন মাফ। এর কারণ আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। কেঁদে কেঁদে মায়ের কাছে নালিশ করতে গেলে তিনি আমার আদর করে ভুলিয়ে দিতেন।
পড়াশোনায় আমি বরাবর ভালো ছিলাম। ক্লাসে প্রতিবছর প্রথম হতাম। তাই স্কুলের হেড দিদিমণি আমাকে খুব ভালবাসতেন। বহুবার প্রয়োজনে তিনি আমার খাতা, বই, কলম কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার এই সামান্য “প্রয়োজন” টুকুও বাবার কাছে ছিল অযথা পয়সা নষ্ট। রেজাল্ট ভালো হলে মা যতটা খুশি হতেন, বাবার মুখে কিন্তু আমি কোনদিন একটা বাক্যও শুনিনি। তবে বহুবার ভাইকে বলতে শুনেছি, ” তুই আমার গৌরব”। ও টেনেটুনে পাশ করলেও বাবার আনন্দের সীমা থাকতো না। বহুদিন ওই মা দুর্গার কাছেই নালিশ করেছি, প্রশ্ন করেছি, এমন কি অপরাধ করেছি আমি যে বাবা আমায় ভালবাসেন না??
এর জবাব একদিন নিজে কানেই শুনলাম। তখন আমার মাধ্যমিকে দু-মাস বাকি। মা রাত জেগে আমায় পড়তে দিতেন না। তাই আমি টর্চ নিয়ে লেপের তলায় পড়তাম। একদিন এভাবেই পড়ছিলাম। হঠাৎ পাশের ঘরে শুনলাম মা-বাবার ঝগড়ার শব্দ। পা টিপে দড়জায় কান পাততেই শুনতে পেলাম আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নের উত্তর। বাবা বলছেন, ” যেদিন জানতে পেলাম তোর পেটে মেয়ে আছে সেদিনই বলেছিলাম, মেরে ফেল এই অলক্ষীকে। কিন্তু তুই শুনলি না। জেদ করে ঘরে বয়ে আনলি এই বোঝাটাকে। সারা জীবন আমার রক্ত শুষে খেল। আবার আমার ঘারে কোপ দিয়েই এটাকে পার করতে হবে আরেক বাড়ি। তা বিনি পয়সায় যখন এই বোঝা নামানোর সুযোগ পেয়েছি, সেটা আমি কিছুতেই হাতছাড়া করবো না। এই আমার শেষ সিদ্ধান্ত মনে রাখিস।”
আর শোনার সাহস বা ক্ষমতা কিছুই ছিল না আমার। দুই কানে হাত দিয়ে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পরলাম। কত কথা সেই অভিশপ্ত রাতে আমার মনে পড়েছিলো। দুর্গাপূজার জন্য যখন বাবা কলকাতায় যেতেন, তখন ভাইয়ের জন্য আসতো দুই-তিন জোড়া শার্ট-প্যান্ট, নতুন জুতো। আর আমার ভাগ্যে জুটতো দোকানের সবচেয়ে কমদামি জামাটি। একমাত্র আমার জন্যেই যে মা নিজের কতো সুন্দর সুন্দর শাড়ি কেটে ফ্রক তৈরী করে দিয়েছিলেন তার হিসাবে নেই। কিন্তু বাবার কাছে আমি “বোঝা! “। আমাকে মায়ের পেটেই মেরে ফেলতে তাঁর এতটুকু দ্বিধা বোধ হয়নি! প্রশ্ন করলাম অদৃষ্টকে, ঠাকুমা না থাকলে বাবা কী করে আসতেন?? মা না থাকলে ভাই কী করে হতো?? তাহলে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে আমি এমন কি মহাপাপ করেছি??
সেদিন রাতে বাইরে গাছের পাতাগুলো যেমন বৃষ্টিতে ভিজেছিল, তেমনই ভেতরে চোখের জলে ভিজেছিল আমার বালিশ। পরদিন সকালে মায়ের গালে দেখেছিলাম গত রাতের ঝড়ের পরিণাম। কিন্তু কিচ্ছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না। মা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ” আমার একটা কথা রাখবি মা?”
কি বল মা?
তুই এবার মাধ্যমিকে ইচ্ছে করে ফেল কর।
বিষ্ময়ের অবধি রইলনা আমার। বললাম, “কেন মা? কি বলছো তুমি?? আমি যে স্কুলের প্রথম ছাত্রী! সারা স্কুল আমার জন্য মুখিয়ে আছে!!!”
মা বললেন, ” তুই পাশ করলেই বাবা তোর বিয়ে দিয়ে দেবেন। পাত্রও স্থির হয়ে গেছে”।
কিছুক্ষণ দুজনেই নির্বাক হয়ে রইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে পাত্র??
মা বলে, পাশের গ্রামের নির্মল বাবু। আমার পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। বাবার স্থির করা এই সুপাত্রটিকে আমি ছোটোবেলা থেকে “কাকু” বলে ডাকি। বয়স প্রায় ৩৭। গত বছর কাকীমার মৃত্যুর পর ছেলে-মেয়ে দুটি মাতৃহারা হওয়ার তাঁর এই শুভবুদ্ধি উৎপন্ন হয়েছে। আমাদের বাড়িতে যাতায়াত থাকার দরুন আমাকে নাকি তিনি ছোটোবেলা থেকে পছন্দ করতেন। যাকে কি না আমি কাকু, মানে বাবার ভাই বলে গণ্য করি, তাঁর আমার প্রতি এই নজর??? শুনে নিজের প্রতিই যেন ঘেন্না হল… মাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা মেনে নিলেন??
জবাবে তিনি বলেন, নির্মলবাবু বলেছেন তোকে বিয়ে করলে তিনি এক টাকাও পণ নেবেন না। তাই বাবা…..
হায় রে সমাজ! হায় রে পুরুষের অহংকার!
আর আমার বাবা?? তিনি তো ঘাড় থেকে বোঝা নামাতে পারলেই বাঁচেন। বিশ্বাস হল না… দুর্গা পূজার সময় যে লোকটা মা দুর্গার আরাধনায় মগ্ন থাকেন, মৃন্ময়ীর আগমনের আনন্দে যিনি আত্মহারা হয়ে পড়েন, সেই মানুষটা আসলে রক্ত মাংসের দুর্গাকে “বোঝা ” ভাবেন!!!
কোনও কথা বললাম না। নিঃশব্দে পড়াশোনায় মন দিলাম। বলা বাহুল্য, মাধ্যমিকেও আমি দশটা গ্রামের মধ্যে প্রথম হলাম। রেজাল্টের দিন মা যতটা খুশি হয়েছিলেন, এর চেয়ে অনেক বেশি আতংকিত হয়েছিলেন। কারণটা আমি জানতাম। তাই কোনও কথা না বলে সেদিন রাতেই মায়ের আলমারি থেকে ৫০০টাকা চুরি করে ভোর হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইলাম। কাকভোরে ঘুমন্ত মাকে প্রণাম করে সোজা চলে গিয়েছিলাম হেড দিদিমণির বাড়ি। সব খুলে বললাম। তিনি সব শুনে শুধু একটা দ্বীর্ঘশাস ছেড়ে আমার মাথায় হাত রাখলেন। এরপর আমাকে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায় তাঁর বোনের বাড়ি। সেখানে থেকেই আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করি। আমার পড়ার খরচও হেড দিদিমণিই দিতেন। মায়ের খবর নিতাম তাঁর কাছেই। আমার জন্য মায়ের উপর কতো যে অত্যাচার হয়েছিল তা বোধকরি লিখে বলতে হবে না। হেড দিদিমণি মাকে সবকিছু জানিয়েছিলেন। আর মা, দূর থেকেই আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে বি এ পড়ার খরচ আমি নিজেই টিউশন করে বহন করেছি। এরপরে এম এ করি। আজ আমি কলকাতার এক নামজাদা কলেজের লেকচারার। দুই যমজ মেয়ের মা। আমার স্বামীও এক কলেজে পড়ান। আমি সৌভাগ্যবতী যে এমন জীবনসঙ্গী পেয়েছি। ছেলে-মেয়েতে তিনি তফাৎ করেন না। আমাকে সব স্বাধীনতা তিনি দিয়েছেন। বিয়ের পর যখন জানতে পারি, ভাই মায়ের উপর অত্যাচার করছে তখন গ্রামে গিয়ে জোর করে মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসি। আজ মা আমার কাছে ভালো আছেন। অথচ বাবার মৃত্যুর খবরও আমাকে গ্রামে টেনে নিয়ে যেতে পারেনি।
সে যাই হোক, দুর্গাপূজার আর বেশিদিন বাকি নেই। একদিন সকালে চায়ের টেবিলে স্বামীকে বললাম, ” শুনলে তোমার মেয়েদের ইচ্ছে? একজন পাইলট, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় । ” তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, ” কি যে হয়েছে আজকালকার মেয়েদের? এত লেখাপড়া করে কি হবে শুনি? এই ছোট ছোট ড্রেস পরে বুক দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটে, রাতে পার্টি করে, এরপর এদের দেখে কোন ছেলের লোভ হলে সব দোষ ছেলেদের। বলি, তাহলে শরীর দেখিয়ে পুরুষদের আমন্ত্রণ জানানোর দরকার কী? ” আমি হতবাক হয়ে শুনলাম… জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে আমাকে এত স্বাধীনতা দিলে কেন?”। তিনি বললেন, ” তুমি তোমার টাকা খরচ করে স্বাধীনতা ভোগ করছো। আমার কাছে তোমার এসব বাজে খরচের জন্য টাকা নেই।” আমি ওই মুহূর্তে সত্যিই হতবুদ্ধি হয়ে গেছিলাম। তিনি আরও বললেন, ” বুঝলে, এবার পাড়ার ক্লাবের মেমবাররা খুব ধরেছে। বলছে পাড়ার পুজোয় দুর্গার শাড়ি কাপড় আমার দিতে হবে। ভাবছি বেনারসি কিনে আনবো। প্রেস্টিজ বলেও একটা কথা থাকে কি না?? আর তোমার মেয়েদের এবার পুজোয় কিছু কিনে দিতে পারবো না। খরচ তো কম নয়??” বললাম, না হবে… ওদের জন্য আমার বেতনই যথেষ্ট।
বেডরুমে আসতেই আয়নায় নিজের ছোটোবেলার ছবিটা স্পষ্ট ফুটে উঠলো। আসলে প্রত্যেকটা পুরুষই জীবনের কোনও না কোনও ক্ষেত্রে নারীদের নিজের চেয়ে নিচু মনে করে। তবে জীবনে চলার পথে শারীরিক শক্তির চেয়ে মানসিক দৃঢ়তাটা যে অনেক বেশি প্রয়োজন, তা বেশিরভাগ পুরুষেরই বুঝার ক্ষমতা নেই। তাই হয়তো আমার স্বামীর ভাষায়, “মেয়েদের এত লেখাপড়া করে কি হবে?? সেই তো হেঁসেল সামলাবে আর স্বামীকে বিছানায় খুশি করবে।” কিন্তু আমি দুর্গা। আগে নিজের জন্য লড়েছি, এবার মেয়েদের জন্য লড়বো। আসলে প্রত্যেক নারীর ভেতরই দুর্গা থাকেন। আমরাও পারি অসুর বধ করতে। অসত্যকে পরাজয় করে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে। কালী হয়ে কলংক মেটাতে। লক্ষী হয়ে সংসার করতে নতুবা সরস্বতী হয়ে বিদ্যা দিতে। আমরা নারী, আমরা সম্পূর্ণা….অপেক্ষা শুধু নিজেকে চিনে নেওয়ার…….