তমোজিৎ সাহা
স্বাধীনতার পর প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস। জওহরলাল নেহেরু ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করলেন প্রজাতন্ত্র দিবসের পদযাত্রায় সানাই বাজানোর জন্য। প্রথমেই নাকচ করে দিলেন।’–একমাত্র মহরমের দিন ছাড়া আমি দাঁড়িয়ে সানাই বাজাই না।’ নেহেরু দিনটির গুরুত্ব বুঝিয়ে আবার অনুরোধ করায় রাজি হলেন। খাঁ সাহেব ভাবনায় পড়লেন, কী বাজানো যায় ! হঠাৎ বেনারসের ঘাটে মাঝিদের গানের সুর কানে এল। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললেন কী সুর বাজাবেন। সেদিন বাজালেন ‘গঙ্গা দুয়ারে বানাইয়া বাজে’। সানাইয়ের সুরে সেদিন দেশবাসীর কাছে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের মেঠো সুর পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
শৈশবের কথা বলতে গিয়ে বলতেন,’ প্রতিদিন ভোরবেলা গঙ্গায় স্নান করে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তাম।তারপর বালাজি মন্দিরে গিয়ে সারাদিন সানাই বাজাতাম।কই, কোনোদিন তো অসুবিধা হয়নি।’ বলতেন, ‘ দেখ, আমার হাতে রাজ্যপাট থাকলে আমি আইন করতাম–সকলকে সুর শিক্ষায় করতে হবে, সুরের মানুষ হতে হবে। কারণ সুর মানুষকে ভালো করে দেয়।’
সানাইয়ের সুরসম্রাট ভারতরত্ন ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ। তিনিই পরবর্তীতে খাঁ সাহেবের স্মৃতিচারণ করে উপরের কথাগুলি লিখেছিলেন। আমরাও আজ খাঁ সাহেবকে তাঁর ১৪ তম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। ভারতীয় রাগসঙ্গীকে যারা নির্মাণ করেছেন সারাজীবনের সাধনায়, তাঁদের সেই সুরে মিশে আছে সম্প্রীতির তান। ভারতীয় সঙ্গীতের পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা এই সম্প্রীতির সাধনায়। বিসমিল্লা খাঁ এই সুরসাধনার অন্যতম প্রধান স্হপতি। তিনি একাই নিজ প্রতিভার গুণে সানাইয়ের সুরমূর্চ্ছনাকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়ে বিশ্বজয় করেছিলেন। ওস্তাদজি আজ নেই, তাঁর স্মৃতি এবং ঐতিহ্যও ক্রমশ বিলুপ্তপ্রায়। তাই আজ বড় বেদনার সঙ্গে এই মহান শিল্পীকে আমাদের ম্মরণ করতে হচ্ছে।
এর কারণ, দিনকয়েক আগে পাওয়া একটি সংবাদ আমাদেরকে আলোড়িত করে তুলেছে। সংবাদে জানা গেছে খাঁ সাহেবের স্মৃতিবিজড়িত বেনারসের বাসগৃহটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যে বাড়িটি ছিল একটি দর্শনীয় স্হান, আমাদের ঐতিহ্যের অন্যতম আধুনিক নিদর্শন সেই বাড়িটিই ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল আর কেউ নয় তাঁরই পরিবার। হতভাগ্য জাতি আর কাকে বলে! সে জায়গায় প্রমোটারের কল্যাণে এবার নাকি গড়ে উঠবে শপিং মল। এমন দুর্ভাগা দেশ আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাবেন না।
বিসমিল্লার সানাইয়ের জাদু আবিশ্বকে তো মুগ্ধ করে রেখেছিল, তবে আমেরিকায় আলোড়নটা একটু বেশিরকম হয়েছিল। কথিত আছে সেদেশের সরকার একবার খাঁ সাহেবকে আমেরিকার নাগরিকত্ব এবং বিলাসবহুল জীবনের উপকরণ উপহার দিয়ে তাঁকে সেদেশে নিয়ে যেতে চায়। ওস্তাদজি সবিনয়ে সে উপহার প্রত্যাখ্যান করে বলেন তিনি তো আমেরিকায় গঙ্গাকে পাবেন না। গঙ্গা নদী খাঁ সাহেবের সুরসাধনার সঙ্গে এভাবেই সারাজীবন মিশে ছিল। তাই শেষ জীবনে বিশাল পরিবারের ভরণপোষণ সামলাতে না পারলেও দারিদ্র্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, কিন্তু তবুও বারাণসীর ঘর ছেড়ে , গঙ্গাকে ছেড়ে কোথাও যাননি। দোতলার একটি ঘরে বসে সারাজীবন সঙ্গীতের সাধনা করে গেছেন। আর আজ তাঁর উত্তরপুরুষরাই শিল্পীর রেওয়াজের ঘরটি ভেঙে দিল!
১৯৬৩ সালে কেনা বাড়িটির দোতলার নির্দিষ্ট ঘরে বসে রোজদিন স্নান সেরে সানাইয়ের রেওয়াজ করতেন খাঁ সাহেব। ওই ঘরটিতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর অনুরাগী এবং ছাত্ররা চেয়েছিলেন ঘরটিকে সংরক্ষণ করে মিউজিয়াম বানিয়ে শিল্পীর স্মৃতিকে রক্ষা করবেন। কিন্তু কেউ এই উদ্যোগে এগিয়ে এলেন না। বারবার সরকারের কাছে এ বিষয়ে আবেদন জানালেও সরকারের তরফে কোনো উৎসাহ বা সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। অভিযোগ হল যে খাঁ সাহেবের অন্যতম পুত্র মেহতাব হোসেন বর্তমানে বাড়িটির মালিক। তাঁর পুত্রই নাকি এই ভাঙননাট্যের গুরু। ২০১৭ সালে এই নাতিই মাত্র সতেরো হাজার টাকায় ওস্তাদজির চারটি বহুমূল্য সানাই বিক্রি করে দিয়েছিল। যার মধ্যে তিনটি সানাই ছিল রূপার তৈরি। কিছুদিন আগে যখন ভাঙনপ্রক্রিয়া শুরু হয় তখনও উত্তরপ্রদেশ সরকার চুপচাপ বসে থেকেছে। আর এখন তো পুরো বাড়িটিই ধূলিসাৎ হবার পথে। একমাত্র প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব টুইট করে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আর পরিবারের ভেতর থেকে খাঁ সাহেবের পালিতা কন্যা সোমা ঘোষ এই ঘটনায় ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছেন। তবু তিনি বলেছেন শেষ চেষ্টা করবেন ঘরের বাকি অংশাটা যদি বাঁচানো যায়।
যদি সরকার এখনই তৎপর হয়ে হস্তক্ষেপ করে তবে অবশ্যই বিসমিল্লা সাহেবের বাড়িটি রক্ষা করা যেতে পারে। আর নইলে শিল্পীর প্রয়াণ দিবসে আমাদের বিলাপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। যেভাবে একের পর এক দেশের সম্পদ ব্যক্তি মালিকানার কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সেখানে প্রমোটারের লোভের দৃষ্টি থেকে কিংবদন্তি শিল্পীর বাড়িটিকে বাঁচানো এক কঠিন চ্যালেঞ্জ বটে। বিদেশের পাশ্চাত্য দেশগুলি এমন কি জাপানের মতো দেশের কাছ থেকে কীভাবে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হয় তা আমাদের শেখা উচিত। এই সেদিনও একটি বইয়ে দেখলাম মাইকেল মধুসূদন ফরাসি দেশের যে বাড়িটিতে থাকতেন সেখানে কবির সম্মানে একটি ফলক লাগিয়ে বাড়িটিকে আজও সযত্নে রক্ষা করা হচ্ছে। আর আমাদের পোড়া দেশে এসব ঐতিহ্য স্মৃতির কোনো মূল্যই নেই। আমাদের শিলচর শহরই তো এর জীবন্ত প্রমাণ। চন্দবাড়ি-দত্তবাড়ি সহ অসংখ্য ঐতিহাসিক বাড়ির বানিয়াদের হাতে বিক্রি হয়ে যাওয়া এবং ব্যবসায়িক অট্টালিকা নির্মাণ তো আমরাও আটকাতে পারিনি! ভবিষ্যতের ইতিহাস এজন্য আমাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না।