33 C
Guwahati
Thursday, June 8, 2023
More

    মহামারীর বিভিন্ন পর্যায়

    চন্দন ভৌমিক

    করোনা মহামারি যার পোশাকি নাম কোভিড-১৯ ২০১৯ এর ডিসেম্বরের কোনও এক সময়ে চিনের উহান প্রদেশ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথম পর্যায়ে উহান প্রদেশ আক্রান্ত হয়ে চিনের অন্যান্য কিছু প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে,  তারপর উহান সহ চিনের আক্রান্ত প্রদেশগুলির মধ্যে যাতায়াতকারী (কর্মসূত্রে) যাত্রীরা নিজ নিজ দেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অজান্তে বহন করে নিয়ে গেলেন মারণ ভাইরাস কোভিড-১৯ কে। মূলত ২০২০-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি অবধি আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি ভাইরাস পৌছে গেল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। মার্চ থেকে এপ্রিল, খুব দ্রুতলয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলির প্রথম সারির ধনাঢ্য দেশ আমেরিকা, ইতালি, ইংল্যান্ড সহ বেশিরভাগ দেশ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। মৃত্যুর মিছিল ক্রমবর্ধমান হতে থাকে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পঙ্গু বা অসহায় হয়ে পড়ে।

    আমাদের দেশে এর আগমন একই সময়ে ঘটতে থাকেলেও কেন্দ্রীয় সরকারের সময়োচিত ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহন করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা এবং সর্বোপরি ২৪ ফেব্রুয়ারি আহমেদাবাদে “নমস্তে ট্রাম্প” নামক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচুর লোকের সমাগম ঘটিয়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম পর্যায়ে পৌছে দেওয়া হয়।

    ১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু এবং ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ বিশ্বের সমস্ত দেশ ও জনগোষ্ঠীকে সংকটের মুখে এনে দাড় করিয়ে দিয়েছে।চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত ডাক্তার ও বিজ্ঞানীদের দেওয়া ধারণা অনুযায়ী মহামারী মূলতঃ চারটি পর্যায়ে সংক্রমণ ঘটাতে থাকে।

    প্রথম পর্যায়ঃ সংক্রমিত এলাকা থেকে পরিযায়ীদের মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে, এক দেশ থেকে অন্যদেশে পরিবাহিত হতে থাকে। প্রথম পর্যায়টা মারাত্মক না হলেও এখান থেকেই ভাইরাস ছড়াতে শুরু করে। এই সময়ে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটে না। শুধু যাদের সংক্রমিত জায়গায় বেড়ানোর (কর্মসূত্রে ও বিভিন্ন কারণে) ইতিহাস রয়েছে, তারাই সংক্রমিত হয়ে থাকে।

    দ্বিতীয় পর্যায়ঃ এই পর্যায়ে স্থানীয়দের মধ্যে সংক্রমণ ঘটতে শুরু হয়। সংক্রমিত এলাকায় ভ্রমন করে আসা ব্যক্তিদের মাধ্যমে। সাধারণতঃ পরিবারের লোকজন ও বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে ছড়াতে শুরু হয়। এই পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়ানো এবং সংক্রমিত ব্যক্তিদের সহজে পৃথকীকরণ করা যায়।

    তৃতীয় পর্যায়ঃ এই পর্যায়ে সংক্রমণের কারণ ও হদিস পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। যাদের কোনও ভ্রমনের ইতিহাস নেই তাদের মধ্যে ভাইরাসের আক্রমণ হতে থাকে। সংক্রমণ চরম পর্যায়ে যেতে থাকে এবং নিয়ন্ত্রনের বাইরে যেতে শুরু করে।

    চতুর্থ চরম পর্যায়ঃ এই পর্যায়ে সংক্রমণ কোনও কারণ ও ইতিহাস ছাড়াই সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ছড়াতে থাকে। পাড়া, মহল্লা হয়ে সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

    ৪র্থ পর্যায়ে খুব দ্রুতলয়ে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনা ভাঙ্গতে শুরু করে। যেমন- ১) স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হতে শুরু করে এবং অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মৃত্যুভয় এবং সংক্রমণের ভয়ে অধিকাংশ পরিষেবা প্রদানকারীরা দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে পিছু হঠতে শুরু করেন। এই সময়ে মানব সভ্যতা এক অমানবিক পর্যায়ে প্রবেশ করতে শুরু করে। বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগী, অথর্ব রোগী সঠিক ও সময়মত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

    বেশ কিছু ঘটনায় দেখা যাচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্সে ও হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু ঘটছে। মৃতদেহ ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রলিতে, মেঝেতে পড়ে থাকছে। ভাইরাসের কঠোর নিয়মাবলীর কারণে মৃতের আত্মীয়স্বজন কাছে না আসতে পারার জন্য মৃতদেহ সঠিকভাবে প্যাকিং ও ধরার লোকের অভাবে দীর্ঘক্ষণ বেওয়ারিশ লাশের মত পড়ে থাকছে। সৎকার করতে গিয়েও দীর্ঘক্ষণ হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।  আবার পরিষেবা ভেঙ্গে পড়ার কারণে অনেক রোগী ও মৃতদেহের খোজ মিলছে না। এছাড়া কিছু অসাধু চক্র গড়ে উঠেছে যারা ৫০০/১০০০ টাকার বিনিময়ে কোভিড আক্রান্ত রোগীর পথ্য, খাওয়া বা জীবনদায়ী ঔষধ পৌছে দিচ্ছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, রোগী কেমন আছে, মৃত না জীবিত অথবা রোগীর ছবি মোবাইলে ক্যামেরা বন্দি করে যারা এনে দেখান তাদের উপঢৌকন দিতে হচ্ছে।

    এই অমানবিক চিত্রটা প্রকট হয়ে উঠেছে দিন দিন সর্বত্রই। আমাদের দেশ তথা বিভিন্ন রাজ্যে একই অবস্থা। রাজ্য বা অঞ্চল ভেদে কিছুটা তারতম্য আছে হয়ত। এই অবস্থা থেকে যদি অতিসত্বর উত্তরন না ঘটে তাহলে এর সূদূর প্রসারী প্রভাব পড়তে পারে, যেমন- 

    ১) স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়তে পারে। কোভিডের চিকিৎসার পাশাপাশি জটিল রোগে আক্রান্ত  রোগীরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন। মৃতদেহ বেওয়ারিশ ভাবে পড়ে থাকতে শুরু হবে। মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে ভেঙ্গে পড়তে পারে।

    ২) জরুরি পরিষেবা যেমন বিদ্যুৎ, জল, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাজারহাট, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থবির হয়ে যেতে পারে। পরিষেবা প্রদানকারীরা আক্রান্ত হয়ে পরিষেবা দেওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

    ৩) সামাজিক সমস্ত রকমের ব্যবস্থা ও সরকারি ব্যবস্থাপনা লোকের অভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।

    ৪) সমাজের মূল কাঠামোকে ধরে রাখার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাও ধসে পড়তে পারে।

    ৫) আর্থিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। কাজ হারিয়ে, খাদ্যের অভাবে অসংখ্য লোক অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। 

    ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ভারতে ৪২৪৮০ জন কৃষক ও দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। এমনিতেই বর্তমান দেশে প্রতিদিন ৩৮ জন বেকার ও ১১৬ জন কৃষক আত্মহত্যা করছেন। কোভিডের মৃত্যু এর থেকে আলাদা। এই সংখ্যা আগামী দিনে আরও বাড়তে ত্থাকে।

    এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে আমরা মানব সমাজ একমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছি কবে এই মারণ রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবে এবং কবে আমরা মৃত্যু মিছিলের হাত থকে রেহাই পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসব। অতিমারির চতুর্থ বা বর্তমান পর্যায়ে বিশ্বের মানব সমাজ চরম সংকটের সম্মুখীন।

    এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চার শতক পড়ে ও আগের মহামারিগুলির মত একই পরিস্থিতির শিকার বা অসহায়ত্ব কেন বোধ করব আমরা। বর্তমান সময়ে আমরা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উন্নতির চরম পর্যায়ে থেকে আমরা মৃত্যু মিছিলকে কেন আটকাতে পারছি না। আজ এই লেখাটি যখন লিখছি বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত ২,৭৭,৮৮,৪১৯, মৃত্যু ৯,০২,৳২৪, ভারতে আক্রান্ত ৪৩, ৭০, ১২৮, মৃত্যু ৭৩,৮৯০। আমরা কি ভ্যাকসিন না বের হওয়া পর্য্যন্ত এই বাড়ন্ত সংখ্যাগুলি শুধু গুনতে থাকব? মৃত্যু মিছিল কি ১০০ মিলিয়ন সংখ্যাকে পেরিয়ে যাবে।

    কিছু দেশ ও কোম্পানি খুব দ্রুত ভ্যাকসিন নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। অনেকেই এখন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে। কিন্তু দেখা গেল অক্সফোর্ডের তৈরি ভ্যাকসিনে বিপত্তি। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর এক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

    যখন করোনাতঙ্কে গোটা বিশ্ব ও আমাদের দেশ জবুথুবু, তখন কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের শাসক করোনার আবহের আড়ালে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া, বিভিন্ন রাষ্টায়ত্ত ক্ষেত্র বিক্রি করে দেওয়া, কর্ম সংকোচন, গণতন্ত্রের বিভিন্ন স্তম্ভের উপর ক্রমাগত আঘাত ও কুক্ষিগত করার প্রয়াস প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে।

    সংক্রমণের শুরুতে শাসক গোষ্ঠী ও তাদের অনুগামীরা নির্লজ্জের মত করোনার প্রতিষেধক হিসাবে গোমূত্র, গোবর, পাপড় অন্যান্য অবৈজ্ঞানিক তথ্য জনগনের সামনে তুলে ধরেছিল। আজ তারাই মুখে কুলুপ এটে বসে আছে। ভিআইপি ও নেতা-মন্ত্রীরা সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় ভরসা না করে, দামী দামী বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করছেন। কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, হয়ত এই টাকা জনগণের পকেট থেকেই যাবে।

    করোনা সংক্রমণের শুরুতেই সঠিক পরিকল্পনার অভাবে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক হাজার হাজার কিলোমিটার পায়ে হেটে বাড়ি ফিরেছেন। অনেকেই রাস্তাতেই মারা গেছেন। বাড়িতে এসেও কাজ খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছেন।

    এই অতিমারি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের ভ্যাকসিন এর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। তবে আমাদের যেমন সতর্ক থাকতে হবে তেমনই সরকারকে প্রতি পরিবারের খাদ্যের যোগান চালু রাখতে হবে। অতিমারির কালে প্রতিটি পরিবারকে পর্যাপ্ত ভাতা দিতে হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে যে কোনও মূল্যে সক্রিয় করে রাখতে হবে। সরকার জনসাধারণের প্রয়োজনেই নির্বাচিত হয়েছেন, কাজেই জনগণকে বাচানোর দায়িত্ব  তাদেরকেই নিতে হবে।##

    (নিবন্ধে উল্লিখিত মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।)

    Published:

    Follow TIME8.IN on TWITTER, INSTAGRAM, FACEBOOK and on YOUTUBE to stay in the know with what’s happening in the world around you – in real time

    First published

    ট্ৰেণ্ডিং