রাহুল রায়
সামাজিক মাধ্যম আজ দেশের শিক্ষিত সমাজের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হাতে মোবাইল মানেই তো সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতি নিশ্চিত। আরো পরিষ্কার করে বললে ফেসবুকের নেশা এই দেশে এত বেশি যে এই বছর পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় ভারতেই সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ডাউনলোড হয়েছে। এই প্রবণতা স্বাভাবিক ভাবেই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেশি। এদেশের মানুষের সঙ্গে আন্তর্জাল ভিত্তিক এই সামাজিক মাধ্যমের প্রথম পরিচয় ঘটায় ওর্কুট, পরবর্তীতে সেই ধ্বজা হাতে নিয়ে নেয় আমেরিকার ফেসবুক কোম্পানী। পরিচিত-অপরিচিত মানুষের জীবনের বিভিন্ন খবর, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কার্যকলাপ, দেশ-বিশ্বজগতের নিত্যনতুন খবর ফেসবুকের পেজগুলোতে অত্যন্ত সুলভ। অনবরত আসতে থাকা ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন খুঁটিনাটি খবরের ফাঁক দিয়ে কখন যে একজন মানুষের ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইল ও কম্পিউটারের পর্দার মধ্যের এই সমান্তরাল জগতে কেটে যায় ধরতে পারা দুষ্কর হয়ে যায়। মানুষও তার নিত্যদিনের সমস্যা, চাপ কাটিয়ে নিতে এই সমান্তরাল জগতে কিছু সময় কাটিয়ে নেয়। এই একঘেয়েমি কাটানোর মধ্যে দিয়েই তার হাতে অনেক তথ্য, খবরও এসে যায়, স্বাভাবিক ভাবেই এই নতুন জগতের মোহে, চাকচিক্যে তার কাটানো সময়ের পরিমাণও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। একজন ভারতীয় ব্যবহারকারী দিনে গড়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থাকেন। সামাজিক জীবনের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে যোগ হওয়া এই নির্ভেজাল অংশের কাজকর্ম নিয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ বা অভিযোগ থাকার কথা নয়।
কিন্তু সমস্যা হল যে কোনো ব্যবসায়ের মতো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষও নৈতিকতা বর্জন করে। ২০১৮ সনে কেম্ব্রিজ এনালাইটিকা অধ্যায়ের রহস্য উন্মোচন সামাজিক মাধ্যমের পেছনের কদর্য রূপকে সামনে তুলে ধরে। বলা হয় যে ফেসবুকে থাকা সাধারণ মানুষের বিভিন্ন তথ্যের রাজনৈতিক ব্যবহার করে আমেরিকা, ব্রিটেন, নাইজেরিয়া এমনকি ভারতেও কিছু রাজনৈতিক দলকে সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে। বিনিময়ে মোটা টাকার লেনদেন হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কিরকম করা সম্ভব। একজন ব্যবহারকারী সে তার মনমতো করে ফেসবুক ব্যবহার করে, তাতে রাজনৈতিক স্বার্থ কিরকম সন্তুষ্ট করা সম্ভব? উত্তর হল, সম্ভব, অতিমাত্রায় সম্ভব। কি ভাবে সেটা সম্ভব দেখা যাক। বিজ্ঞানের ভাষায় এই ব্যবহারকে বলে ‘psychographic profiling’ । প্রশ্ন দাঁড়ায়, কিভাবে হয় সেটা ।
ফেসবুক ব্যবহারকারীরা নিজের মতো করে ফেসবুকে আসতে থাকা খবর, ছবি, ভিডিও, পেজে সাড়া দেয়। লাইক, শেয়ারের মতো বিকল্প ব্যবহার করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয়ে নিজেদের মতামত রাখেন। ব্যবহারকারীদের এইসব এক্টিভিটি রেকর্ডস বা কাজকর্মের খতিয়ান ফেসবুকের সার্ভারে জমা হয়ে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থাতেই আমরা যদি কোনো একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ফেসবুক প্রোফাইল খুলে কিছু সময় ব্যয় করি অনায়াসে সেখানে তার কার্যকলাপ দেখে তার মানসিকতা বুঝে নিতে পারি। সে কি ভালোবাসে, কি ভালোবাসে না জেনে নেওয়াটা খুব একটা কঠিন না। কিন্তু আমাদের পক্ষে বেশি মানুষের প্রোফাইল বিশ্লেষণ সম্ভব না, কারণ সবাই আমাদের বন্ধু তালিকায় নেই। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় পেশাদার মানুষের। একজন মানুষের যেমন প্রোফাইল বিচার করা যায় তেমনি যদি একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষের ফেসবুক প্রোফাইল বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই অঞ্চলের মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, চাহিদা অনুমান করা অত্যন্ত সোজা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ফেসবুকের সার্ভারে সঞ্চিত ব্যবহারকারীদের বিস্তারিত তথ্য বিরাট ভূমিকা নেয়। বিশেজ্ঞরা এই খতিয়ানকে বিশ্লেষণ করতে পারেন বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে। অভিযোগ যে এখানেই শুরু হয় অন্য খেলা। বিপুল টাকার বিনিময়ে সার্ভারে সঞ্চিত সেই সব তথ্য রাজনৈতিক দলগুলোর কুশলীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে জনগণের পছন্দের তালিকায় থাকা বিষয়গুলোকে নিজেদের দলের সপক্ষে ও অপছন্দের বিষয়গুলোকে বিরোধীপক্ষের নামে প্রচার চালানো হয়। যেমন ধরা যাক, একটি বিশেষ জায়গার ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মন্তব্য ও পোস্ট থেকে জানা গেল উক্ত জায়গার মানুষ দুর্বল স্বাস্থ্যপরিষেবার কারণে ভূক্তভোগী। এবার দলের অনলাইন প্রচারে দুর্বল পরিষেবাকে সবল করার উদ্দেশ্যটাকে প্রচার করা হল। একের পর এক ছবি, ভিডিও তৈরী করে দেখানো হল যে দলের শাসনে এরকম অনেক জায়গায় অনেক হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে যদিও বাস্তব দুনিয়ার এর মধ্যে অনেকটির অস্তিত্ব থাকে না। আবার এই দুর্বল স্বাস্থ্যপরিষেবার কারণ হিসাবে বিরোধী দলকে দেখিয়েও প্রচার চালানো হয়। সেক্ষেত্রেও একই ভাবে ছবি,ভিডিও তৈরী করা হয়। এরকম প্রচারের মধ্যে সত্য-মিথ্যা কতটুকু সেটা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন থাকলেও পেশাগত আই.টি কুশলীরা গোয়েবলসের নীতি মেনে অনবরত প্রচার চালানোর ফলে স্বাস্থ্যপরিষেবাকে নিয়ে জনমানসে নিজেদের প্রতি বিশ্বাস গড়ে ওঠে। এবং এক্ষেত্রে তাদের পক্ষে বিরাট সুবিধা হয়ে দাঁড়ায় জনমানসের অজ্ঞানতা। ফেসবুক ব্যবহারে কোনো বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না, যে কোনো মানুষ ফেসবুকে যোগ দিতে পারেন না, সর্বোপরি শিক্ষিত নির্বোধরা তো আছেনই, এরা নিজেদের সীমিত গণ্ডির বাইরে কোনো খবরই রাখেন না। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে ভাঙা রাস্তায় বিধ্বস্ব অসমের মানুষকে গুজরাটের রাস্তা বলে আমেরিকার রাস্তার ছবি দেখিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থীর অনুকূলে ফেসবুকে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ভারতবর্ষের মতো দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বিশাল অংশ ফেসবুকে পাওয়া খবরকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেন। রাজনৈতিক দলের আই.টি কুশলীরা এই মানসিকতাকেই কাজে লাগান সবচেয়ে বেশি। পরবর্তীতে সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন হয় ভোটবাক্সে।
এই গেল ফেসবুকের একটি দিক, এবার সামনে এসেছে আরো একটি নতুন দিক । ফেসবুকের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মতামত রাখতে পারেন। কিন্তু সেই মতামত রাখতে গিয়ে কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ , লিঙ্গকে অপমান করার, অপশব্দ বা অশ্লীল ছবি ব্যবহার করলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা আছে। ‘রিপোর্ট’ নামক বিকল্প ব্যবহার করে অভিযোগ করলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ উক্ত মন্তব্য, ছবি বা ভিডিও বিশ্লেষণ ও বিচার করে প্রোফাইল থেকে মুছে ফেলতে পারে। এমনকি প্রোফাইল ব্যবহারকারীকে সতর্কও করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে এই নিয়ম নখদন্তহীন। একটি বিশেষ মতাদর্শের মানুষ, পরিষ্কার করে বললে দেশের বর্তমান শাসক দল সমর্থকরা যা ইচ্ছা তা করে গেলেও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয় না। এই দেশে ব্যবসা ক্ষতি হওয়ার ভয়েই তারা চরম সাম্প্রদায়িক, অশ্লীল, অবৈজ্ঞানিক, অপমানজনক পোস্টগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো নেইই না, উপরন্তু তাদের প্রসারে পরোক্ষ ভূমিকা নেয়। উল্লেখযোগ্য যে কয়েক মাস আগে দিল্লী দাঙ্গার সময় শাসকদলীয় নেতাদের মারাত্মক রকম দাঙ্গা উষ্কানিমূলক পোস্টের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ করা সত্ত্বেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। শুধু তাই নয় কিন্তু, সরকারের সমর্থনে ভূয়ো নাম দিয়ে লক্ষাধিক প্রোফাইল চালু করে সেখান থেকে সাম্প্রদায়িক, অসামাজিক, ভ্রান্তিমূলক খবরের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়, সেগুলোর বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোনো কালেই কোনো ভূমিকা নেয় না। এমনকি সেই প্রোফাইল তথা পেজগুলোকে জনমানসের সামনে আরো বেশি করে তুলে ধরতেও সদর্থক ভূমিকা নেয়।
এই প্রসঙ্গে ১৯৩৬ সনের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। সেবারের বার্লিন অলিম্পিকের স্পনসর কোকাকোলা কোম্পানী জার্মানীর কুখ্যাত নাৎসি শাসকদের স্লোগানের অনুকরণে তৈরি ‘One People, One Nation , One Drink’ ও প্রতীক চিহ্ন হিসাবে ঈগল ব্যবহার করে। এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠলে কোকাকোলা কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল নাৎসিদের চটানো মানে ব্যবসায়িক ক্ষতি বুক পেতে নেওয়া। তাদের এই নীতি ব্যবসায়িক দিক থেকে ভুল ছিল না। তাদের প্রচারের পরিবর্তে নাৎসি অধিকৃত দেশগুলোতে তারা ব্যবসা বিস্তারের অনুমতি আদায় করে নেয়। আজও দেখা যাচ্ছে একই অবস্থা। ব্যবসায়িক সাফল্যের বিনিময়ে বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়িক নৈতিকতা, গ্রাহকদের বিশ্বাস। ভারতের বাজারে টিকে থাকার লোভে ভারতের লোকেদেরই বিপথে চালনা করার আয়োজন করা হচ্ছে । আজকে ২০২০ এর বুকে দাঁড়িয়ে বলতে বাধা নেই যে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যম একটি বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানুষ ফেসবুককে ভরসা করে নিজেদের মতামত রাখেন, এতে আগত খবরগুলোকে বিশ্বাস করেন। জনমানসে থাকা ফেসবুকের সেই ভরসা, বিশ্বাস, গুরুত্বটাকে যদি এভাবে কিছু টাকার বিনিময়ে বা ব্যবসায়িক স্বার্থে বলি দেওয়া হয়ে যায় তাহলে সেটা সমাজের প্রতি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের এক মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা হবে ।
(প্রকাশিত নিবন্ধের মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। এর সঙ্গে টাইম৮বাংলা-র মতামত নাও মিলতে পারে।)