বছরের পর বছর যায়। আসাম আর বিহারে ছবিটা বদলায় না। জেলার পর জেলা দিনের পর দিন জলের নীচে। ধসে যায় শয়ে শয়ে মাটির ঘর। শস্য, গবাদি পশু হানি। প্রাণহানিও কম হয় না। পরিসংখ্যান বলছে, মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু।
গত দু’বছরে আসামের বন্যায় প্রাণ হারিয়েছে ৮৯টি শিশু। এ বছর বন্যায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১১০ জন। তাঁদের মধ্যে ৪৯টিই শিশু। অর্থাৎ মৃতদের মধ্যে ৪৫.৫ শতাংশ শিশু। ইউনিসেফ বলছে, ২৭ লক্ষ শিশুর ওপর পড়েছে এই বন্যার আঁচ। কেউ সংক্রমণে ভুগছে। কেউ বা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। জুলাইয়ে দু’বারের ভারি বর্ষণ পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। আসামের বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের মুখ্য একজিকিউটিভ অফিসার শিশু মৃত্যু নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও আসামবাসীরা বলছেন তাতে পরিস্থিতি বদলাবে না। একই সুর শোনা গেল ১৪ বছরের নাজমা খাতুনের গলায়ও। সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত বরপেটা জেলার বাসিন্দা সে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতির বদল দেখেনি। এখনও মনে আছে নাজমার সেই দিনটার কথা। ওঁর বয়স তখন চার। খাটের ওপর মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল সে। হঠাত্ই ঘরে ঢুকে আসে বানের জল। সেটাও নতুন কিছু নয়।
ছোট্ট নাজমা ঘুম ভেঙে বিছানার ধারে উঁকি দিতে গেছিল। পড়ে যায় জলে। জলে পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙে নাজমার মায়ের। টেনে তুলে নেন মেয়েকে। সে যাত্রায় প্রাণ বেঁচে যায় নাজমার। তবে তাঁর তুতো বোনের ছেলের প্রাণ বাঁচেনি। পাঁচ মাসের শিশু ঘুমের মধ্যে খাট থেকে জলে পড়ে। নদীতে টেনে নিয়ে যায়। ভাবলে এখনও শিউরে ওঠে সে। তবে এই ১৪ বছরের জীবনে এ রকম শিশুমৃত্যু অনেক দেখেছে। কেউ নৌকা থেকে পড়ে গেছে। কেউ খেলতে গিয়ে নদীর জলে তলিয়া গেছে। কেউ স্কুল যাওয়ার পথে বানের তোড়ে ভেসে গেছে।
বেলজিয়ামের এপিডেমিওলজি অফ ডিজেস্টারের গবেষক দেবারতি গুহ সাপির জানালেন, শিশুরা বেশিরভাগ সময় জলের গভীরতা মাপতে পারে না। তাই ডুবে যায়। আর বেশিরভাগ মায়ের একাধিক সন্তান। তাই সবথেকে ছোটটিকেই রক্ষা করতে সক্ষম হন তিনি।
পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য সরকার কী করছে? কিশোরী নাজমার সপাট জবাব, কিছুই না। আগে তারা ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিত। কিন্তু সেখানে পশুর সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। তাই এখন পাটের কাঠি দিয়ে তৈরি এক কামরার ঘরেই খাট পেতে থাকেন নাজমারা। ওই দু’টৌ চৌকিই তাদের সব। নাজমার কথায়, সরকার যদি ঘর উঁচু করার জন্য একটু টাকা দিত, তাহলে আর এ রকম হত না।
ছবিটা কিন্তু বিহারেও আলাদা নয়। এ বছর ৫০ লক্ষ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। তাই শিশু মৃত্যুর পরিসংখ্যান আলাদা করে রাখেনি বিহারের বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর। এ বছর অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হল সরন। এই পরিস্থিতি গত ২০ বছরে দেখেনি এই জেলা। সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই ঘরছাড়া। ২ জন মারা গেছেন। কোভিডের আশঙ্কা জেনেও কোনও মতে ত্রাণ শিবিরে রাত কাটাচ্ছেন। ১৪০২টি রান্নাঘর খুলে খাবার বিলি করছে সরকার।
অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন স্টেশনে। তাদের মধ্যে রয়েছে ১২ বছরের শ্রীকান্তের পরিবার। এই শিশুর কথায়, ‘রাস্তায় জল। তাই ত্রাণ শিবিরে পৌঁছতে পারিনি। স্টেশনে রাত কাটাচ্ছি পরিবারের সাত জন। কিন্তু এখন গুর, চিঁড়ে, ত্রিপল— কিছুই পাইনি।’ শিশুর প্রশ্ন, বছর বছর এসবে ব্যবস্থা করার প্রয়োজনই পড়ে না, যদি সরকার পাকা ঘর করে দেয়। তাঁর স্বপ্ন, একদিন পড়াশোনা করে চাকরি করবে। নিজেই পাকা ঘর করবে। তখন আর বন্যা হলে স্টেশনে থাকতে হবে না।
ফি বছরের বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরাই
Published:
First published