পার্থপ্রতিম মৈত্র
আসাম হচ্ছে আপাতত হিন্দুত্বের টেস্টিং গ্রাউণ্ড, ল্যাবরেটরি। আপনি ভাবলেন এটা বুঝি খুবই লজ্জাজনক, সংবিধান-বিরোধী বাক্যপ্রয়োগ। হায় রাম, আপনার তো রামেই গলদ। যাকে বলছেন, দেখলেন গর্বে তার সিনা টান হতে হতে ৫৬ ইঞ্চি হয়ে গেল। আর শুনলেন উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ এবং আপনার বংশের প্রতিটি মহিলাকে বাক্যধর্ষণের অমৃতসমান বাক্যবিন্যাস।
যা বলছিলাম। অমিত-মোদীর রণকৌশল হচ্ছে প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত অরক্ষিত আতঙ্কিত করে দিয়ে যুদ্ধজয়। এন.আর. সি./ সি.এ.বি, এসব নিয়ে যখন আমরা কেউ কেউ ভারতবর্ষকে সতর্ক করার চেষ্টা করছিলাম, তখন অনেকেই বলেছিলেন ফালতু ভয় দেখাবেন না, ওটা শুধু আসামের জন্য।
অপ্রস্তুত, অরক্ষিত, আতঙ্কিত, ভারতবাসীকে স্তম্ভিত করে দিয়ে অমিত-মোদী যখন ঘোষণা করে দিলেন এটা শুধু আসাম কেন, সারা ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, তখন প্রতিপক্ষ অফগার্ড।
প্রতিটি ক্ষেত্রে একই স্ট্র্যাটেজি। কিন্তু আমরা তো শপথ করেছি, ভুল থেকে কিছু শিখবো না। তাই নোটবন্দী দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল আর করোনা-লকডাউনের মাঝখানে নব্য-জাতীয়-শিক্ষা নীতি পর্যন্ত একই খেলা। বিরোধীরা আঁচ পায় না, প্রস্তাবনা পেশ হয়ে যায়, সবাই কাগজ কলম নিয়ে ব’সে তখন লাভক্ষতির অংক করতে বসে, প্রস্তাব বিপুল গরিষ্ঠতায় পাশ হয়ে যায়।
আসাম হচ্ছে আপাতত বিজেপির টেস্টিং গ্রাউণ্ড, ল্যাবরেটরি। এবার সেখানে নতুন খেলা শুরু হয়েছে। খিলঞ্জিয়া অর্থাৎ ভূমিপুত্রদের নিয়ে শুরু হয়ে গেছে নতুন খেলা। হ্যাঁ করোনা-লকডাউনের মধ্যেই। এন.আর. সি. তে আপনি জানেন ভিত্তিবর্ষ ছিল ১৯৭১। সি.এ.এ তে ভিত্তিবর্ষ করা হলো ২০১৪। সব যদি ঠিকঠাক এগোয় তবে ভারতে এন.আর.সি-র ভিত্তিবর্ষ হতেই পারে ১৯৫১ সাল।

আসামে মাত্র উনিশ লক্ষের সামান্য বেশী আপাতত চিহ্নিত বিদেশী কোনও পক্ষকে খুশী করতে পারেনি। ভিত্তিবর্ষ করা হয়েছিল ১৯৭১ সাল। এবার এসেছে বিপ্লব শর্মা কমিটির সুপারিশ। হঠাৎ করে রাজীব গান্ধীর আমলে করা আসামচুক্তির ৬ নং ধারাকে কবর থেকে তুলে আনা হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে ১৯৫১ সালের আগে যারা আসামে এসেছে তারাই ভূমিপুত্র। সরকারী চাকরীর (৮০% থেকে ১০০%) সংরক্ষণ থেকে শুরু করে সর্বত্র তাদের জন্য সকল সুযোগ সুবিধা।এমনকি জমি বিক্রির বিষয়টিও খিলঞ্জিয়াদের মধ্যেই সংরক্ষিত রাখতে হবে। কাশ্মীরের প্রক্রিয়ার ঠিক উল্টো।
কিন্তু যাই হোক না কেন নাগরিকত্বের মূল ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ থেকে পিছিয়ে ১৯৫১ সালে সরে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে একটি নতুনতর উপাদান। ভূমিপুত্র-কন্যা। বহিরাগতদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরী হয়ে যাচ্ছে। সারা ভারতে এই প্রবণতা ক্রমঃবর্ধমান। পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা তো ছিলই, এবার তার সঙ্গে ভাষা-সাম্প্রদায়িকতাও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশজুড়ে নতুন করে মাৎস্যন্যায় শুরু হলো বলে।সংখ্যাগুরুর ধর্মের পিছনে সংখ্যাগুরুর মূল অংশকে ভিড়িয়ে দেওয়ার সাফল্য আমরা দেখে নিয়েছি। এবার দেখবো সংখ্যাগুরুর ভাষার পিছনে সংখ্যাগুরুর মূল অংশকে ভিড়িয়ে দেওয়ার সাফল্য।

অনাগরিকের সংখ্যা বাড়বে কারণ ৭১ এর প্রমাণপত্র জোগাড় করতে যারা আতংকিত হয়ে উঠেছিল, ৫১ সালের প্রমাণপত্র জোগাড় করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তখন সি.এ.এ দিয়ে তাদের অধিকাংশকে নাগরিকত্ব দেবার চেষ্টা করা হবে। তাতে নিয়ন্ত্রণ বাড়বে, মুসলিমদের প্রান্তিক করে দেওয়া যাবে। এর সঙ্গে ভাষা-সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে পরিস্থিতি এলোমেলো করে দেবে। এলোমেলো করতে পারলেই তো লুটেপুটে খাবার সুবিধা। লকডাউনে অর্থনৈতিক ভাবে বিধ্বস্ত ভারতবর্ষকে, সামাজিকভাবেও বিধ্বস্ত করে দিতে পারলে, দেশটাকেই নিলামে চড়িয়ে দিতে সুবিধা হবে।