বমন, রূপরাজ ভট্টাচার্য
সেই সকাল থেকেই আসিফ পথের পাশে ঠায় বসে আছে । কাঁচা লঙ্কা দিয়ে শুকনো কয়েকমুঠো মুড়ি শুধু পেটে ফেলে এসেছে মাত্র । চারদিন থেকে ভাতের স্বাদ জিভে লাগেনি ।
ঘরে যেটুকু চাল ছিলো দুটি মেয়েকে এ ক’দিন ফুটিয়ে দিয়েছে নাজমা । আজ ডিবি খুলে বৌ ডুকরে উঠতেই আসিফ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কোনোরকমে দৌঁড়ে বেরোয় ঘর থেকে । চোখের সামনে এমন দৃশ্য কাঁহাতক সহ্য করা যায় ।
এতোদিন খুব যে বাদশার চালে ছিলো , তা নয় ; কিন্তু না খেয়ে থাকতে হয়নি কোনোদিন । বরং রয়েসয়ে বেশ ভালোই চলছিলো ।
নূন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসার নয় তার । কষ্টেসৃষ্টে দিনগুজরান চললেও ভিক্ষে করার চিন্তা করেনি কস্মিনকালেও । অথচ কোন এক মারণ ভাইরাস তাকে বিবির নজরে প্রতিদিন শরমের কাঁটায় বিদ্ধ করে চলেছে ।
দুটি মেয়ে নিতান্ত শিশু বলেই আসিফ তাদের কাছে একজন হেরে যাওয়া পিতা বলে সাব্যস্ত হওয়া থেকে খুবজোর বেঁচে গেছে । তবু বিবি আর মেয়ের ভরণপোষণ করার যে পুরুষের মুরোদ নেই, তার গোটা জীবনটাই তো নাপাক ।
আসিফ বড় রাস্তার পাশে সরু ফুটপাতের উপর উবু হয়ে বসে দুই হাঁটুতে মুখ ঢাকে । এখন চাইলেও কাজ মিলবে না ! অথচ দিনের শেষে ঘরে ঢুকতে হবে তো বটেই, কিন্তু খালি হাতে ?
অগত্যা কী মনে করে ঘাড়ের গামছাটা পায়ের কাছে টানটান করে মেলে রাখে আসিফ । দুয়েকটা টুং-টাং আওয়াজ হয় ঠিকই, কিন্তু এতে তো সমস্যা মিটবে না । এছাড়া আর পথও যে নেই ।
হঠাৎ গোঁ গোঁ শব্দে একটা ট্রাক এগিয়ে এসে আসিফের ঠিক নাক বরাবর তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে থামে । পেছনে দুটো বাইকে চারটে খাকি পোশাকের লোক ।
বোঝা গেলো ওরা তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে ছ’পা-ওয়ালা এই মালবোঝাই গাড়িটাকে ।
অনেকক্ষণ উষ্ণ বার্তালাপের পর একটা খাকিধারী ট্রাকের দরজা খুলে হ্যাণ্ডিম্যানের পাশে উঠে বসে , তারপরই আবার আগের মতো আসিফকে কাঁপিয়ে চলেও যায় ।
তবে মড়া ডাল থেকে যেমন শুকনো ঝরা পাতা উড়তে উড়তে মাটিতে পড়ে, ঠিক সেভাবেই আসিফের সামনে বেশ সেলিব্রেটির ভঙ্গিতে হেলেদুলে একটি পঞ্চাশ টাকার নোট কোথা থেকে যেনো এসে হোঁচট খেয়ে পড়ে ।
ট্রাক থেকেই পড়লো বুঝি ? তবে সত্যিই যদি ওখান থেকে টাকাটা পড়ে থাকে তাহলে এর কারণটাও ঠিকই আঁচ করতে পারে আসিফ ।
তা যাগগে যাগগে, আপাতত সেই ফালতু চিন্তা ছেড়ে ডান হাতটা দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরার মতো খপ্ করে টাকাটা ধরে ফেলে । কিন্তু হাতটা সরানোর আগেই একটা বুট জুতো তার হাতের ওপর চেপে বসে ।

যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে আসিফ । মুখ তুলে তাকায় । দেখে একটা আর্মি তাকে ক্রমাগত চোখ নাচিয়ে বিশেষ কোনো ইংগিত করে চলেছে । মানে বাঁ-চোখের ভুরুটা বার বার ওঠানামার মাধ্যমে ইশারায় কিছু একটা জানতে চাইছে ।
আসিফ শুধোয় — “কিতা সার ! কিতা অইসে ? ইলা করোইন কিওর লেগি ?” জওয়ানটা বেশ রোয়াব নিয়েই বলে — “ঘর ছোড়কে ইধার কিঁউ ?” আসিফ আমতা আমতা করে । আর্মিটা আরও জোরে চাপ দেয় ।
আসিফও ততোধিক জোরে চিৎকার করে ওঠে । এবার আর্মি গলা চড়ায় — “লকডাউন মে ঘর মে রেহেনে কে লিয়ে বোলা গ্যয়া । শালা বেহেনচোদ, ইতনা কাহা গ্যয়া, ফিরভি বাহার আ যাতা হে । তুমলোগ হি ইস্ বিমারি কো ফ্যয়লা রহে হো ।”
অনেকদিন ধরেই এমন কিছু কথা শুনে আসছে আসিফ । তার সামনে বা হয়তো তাকে শুনিয়েই অনেকে বলে । আসিফ রা কাড়েনি কোনোদিন ।
কিন্তু আজ একদিকে পেটের খিদে আর অন্যদিকে হাতের তীব্র ব্যথায় মিজাজটা এক্কেবারে খিঁচড়ে যায় —- “আরে সার, আমার খাইয়া কাজ নাই নি রুগ ইখান মাইনষেরে বিলাইয়া দিতাম । ঘরো খানি নাই । বাইচ্চাইটাইন ভুখা , তে কিতা করতাম।”
আর্মি লোকটা সবটা না বুঝলেও ‘ভুখা’ শব্দটাকে ধরে নিয়ে আন্দাজে আসিফের অবস্থা টের পায় । অথচ তার কথায় কিছুমাত্র সহমর্মিতার চিহ্ন দেখা যায় না ।
বরং আরও খরখরে গলায় ব্যঙ্গ করে — “সারা দুনিয়া কা ভুখ স্রিফ তেরে হি পেট মে হ্য ক্যয়া ? কিতনা খাতা হ্য ? শালা ভাগ এহাঁসে ! ঘরমে যা আব ।”
আসিফ হাতের ব্যথাকে এক্কেবারে পাত্তা না দিয়েই নাছোড় জেদে বলে– “পেটো কিচ্ছু নাই সার ! কৈ যাইতাম ; বাড়িত পুলাপাইন না খাইয়া আছোইন, থুড়া যদি রেহেম করোইন !” বলে আর্মিটার দিকে প্রবল ভরসায় ম্লান চোখে তাকায় ।
অথচ জওয়ান আগের মতোই নির্বিকার মুখে খিস্তি করে– “বহত হো চুকা ! আভি বনধ ভি কর ইয়ে সাব বাকচোদি তুঝলোগো কা, শালা !”
আসিফ এবার সত্যিই ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে — “খালি ঘরো রহিয়ে ঘরো রহিয়ে কৈলেউ অয় নি সার ? ঘরো বন্দি থাইকলে রুগ আটকিবো , কিন্তু পেট কিলা ভরতো ?”
আর্মি লোকটা আসিফকে এতোটা গলা চড়িয়ে বলতে দেখে খেঁকিয়ে ওঠে — “শালা কুত্তা কা আওলাদ , ইতনা তেবড় দিখাতা হ্যয় !”
বলেই হাতের রাইফেলের লম্বা নলখানা ওর মুখে সটান ঢুকিয়ে দেয় — “লে খা লে, সারা দুনিয়া কে লোগ মর কর রাখ্ হো রহা হ্যয় , ঔর ইস্ লোগো কো খানে কি পড়ি হ্যয় । শালা তুম লোগ ইস বিমারি মে সর্ রহে হো, লেকিন আপনে কো বচানে কে বদলে ওরো কো মারনা চাহতে হো ? শালা তুমলোগো কো জিনে কা কোয়ি অধিকার নহি ।”
এদিকে আসিফের মুখে রাইফেলের নলটা অনেকক্ষণ থাকায় গলার কাছটা কেমন যেনো উটকে ওঠে, পেটটাও গুলায় । হঠাৎ সকালের মুড়ি আর কিছু পিত্ত শ্লেষা গল গল করে বেরিয়ে আসে ।
আর্মিটা চমকে উঠে আসিফের মুখের ভেতর থেকে রাইফেলের নলটা বের করে সরে দাঁড়ায় । এই অবসরে আর্মির চোখ বাঁচিয়ে একেবারে নির্বিঘ্নেই পঞ্চাশের নোটখানা কিন্তু ঠিক মুঠোবন্দি করে নিতে পারতো আসিফ ।
যে সামান্য একটা নোটের জন্যে তাকে অকারণ অপমান হজম করতে হয়েছে অনেকক্ষণ , ডানহাতে স্টারওয়ালা বুটের চাপে তৈরি হওয়া ক্ষত আর সেইসঙ্গে টনটনে ব্যথা তাকে ভেতরে-বাইরে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে ; অথচ সেই পঞ্চাশের হাল্কা আকাশী নোটটা বাতাসের তোড়ে আবার উড়ে চলে যায় মাঝরাস্তায় ; আসিফের সেদিকে বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ নেই !
তবু এতোকিছুর পরেও তার ডানদিকে হেলানো বাঁকা ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকে তেরচা হাসি ।
আসলে সে মনে মনে কল্পনা করে, তার ভুখা পেটের এতোদিনের জমানো আবর্জনা গুলো রাইফেলের নলে ঢুকে এতোক্ষণে হয়তো বারুদে ভরা কার্তুজে মিশে গেছে ।
কোমরে গামছাটা আচ্ছা করে জড়িয়ে এবার গলা ফাটিয়ে হাসতে থাকে আসিফ । নীরব শুনশান রাস্তা শুধু এর প্রতিধ্বনি শোনায় !