সোমাভা বিশ্বাস
বিভেদ, বিদ্বেষ, বীভৎস আক্রমণ–এসবের সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসকে বিশ্বের অন্যতম বড় উৎসবে বদলে দেওয়ার কাহিনীর নাম নটিং হিল কার্নিভ্যাল।
নটিং হিল কার্নিভ্যাল। রিও কার্নিভ্যালের পর এটিই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্নিভ্যাল। পশ্চিম লন্ডনের কেন্সিংটন অঞ্চলে একটি ছবির মতো সুন্দর জেলা হচ্ছে নটিং হিল। বিগত ষাট বছর ধরে, অগাস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে দু দিন ধরে এই নটিং হিলেই উদযাপিত হয় এক বিরাট স্ট্রিট কার্নিভ্যাল। মূলত ক্যারিবীয় জনগোষ্ঠীর এই উৎসবে প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটে।
‘নটিং হিল’–নামটি শুনলে চলচ্চিত্র প্রেমী অনেকেরই হয়তো নব্বইয়ের দশকের একটি জনপ্রিয় সিনেমার কথা মনে পড়ে যেতে পারে। ছবিটি জুড়ে রয়েছে ছিমছাম, শান্ত, মরশুমি ফুলে সাজানো নটিং হিল– তার সরু ফিতের মতো রাস্তাঘাট, ক্যাফে, ছোট ছোট রঙিন ঘরবাড়ি আর হিউ গ্রান্ট ও জুলিয়া রবার্টসের মিষ্টি প্রেমের দারুণ রোমান্টিক সব দৃশ্য। নটিং হিল নামটি শোনা মাত্র তাই চোখের সামনে ভাসে প্রেম, ভালোবাসা, রোমান্স, পোস্টকার্ডে দেখা ছবির মতো সুন্দর বাড়ি ঘর। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে নটিং হিলের পরিবেশ, পরিস্থিতির সঙ্গে এই ছবির কোনো মিলই নেই। সেই নটিং হিল ছিল ভয়াবহ বিদ্বেষের আরেক নাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে প্রচুর সংখ্যক ক্যারিবীয় মানুষ ব্রিটেনে আসেন। নিজে থেকে অভিবাসন প্রত্যাশী হয়ে নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেনের পুনর্গঠনের জন্য তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল। এমন অবস্থায় এ দেশে এসে তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়ার কথা ছিল, বদলে জুটলো চূড়ান্ত লাঞ্ছনা।
লন্ডনে এসে ক্যারিবীয়রা বাস করতে আরম্ভ করেন নটিং হিল অঞ্চলে। অনেক ব্রিটিশ নাগরিকদের কাছে তারা ‘অনুপ্রবেশকারী’। তাদের কিছুতেই মেনে নিতে পারে না ইংরেজরা। ফলে শুরু হয় ‘কালো হটাও’ অভিযান। ‘কিপ ব্রিটেন হোয়াইট’ স্লোগান তুলে ‘অনুপ্রবেশকারী’দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দেয় ব্রিটিশরা। ক্যারিবীয়দের বাড়িতে পেট্রোলের বোতল ছুড়ে ফেলা থেকে শুরু করে রাস্তায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ নিগ্রহ– সাদা চামড়ার লোকেদের ‘নিগার হান্টিং’এর কিছু উদাহরণ মাত্র। সেই সময় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ব্রিটেনে না ছিল কোনো আইন, না ছিল তা মোকাবেলা করার কোনো ইচ্ছে। এ দেশের প্রশাসন এবং পুলিশ ছিল এমন সব ঘটনার নীরব দর্শক। দিনে দিনে বর্ণবাদীদের অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। ১৯৫৮ এর অগাস্ট মাস। ইংলিশ ফ্যাসিস্ট নেতা অসওয়াল্ড মোসলের মদতে আর ‘টেডি বয়েজ’ নামের বর্ণবিদ্বেষী দলের নেতৃত্বে নটিং হিলের রাস্তায় সংগঠিত হয় ভয়াবহ দাঙ্গা। আহত হন বহু কৃষ্ণবর্ণ মানুষ।
এই বিদ্বেষ, এই ভয়ংকর আক্রমণের প্রতিবাদ জানাতে এবং ক্যারিবীয় সম্প্রদায়কে পুনরুজ্জীবিত করবার জন্যে এক অনন্য উপায় গ্রহণ করা হয়–যার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন দুই নারী। ত্রিনিদাদের বাসিন্দা এক মহিলা সাংবাদিক ক্লডিয়া জোনস এর উদ্যোগে ১৯৫৯ এ শুরু হয় ‘ক্যারিবিয়ান কার্নিভাল’। বর্ণবিদ্বেষের শিকার ব্রিটেনে বসবাসরত ক্যারিবিয়ানরা, সেন্ট প্যানক্রাস টাউন হলে এই কার্নিভ্যালের মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। ক্লডিয়াকে বলা হয় ‘দ্য মাদার অব নটিং হিল কার্নিভ্যাল’। টাউন হলের চার দেওয়ালের বাইরে খোলা আকাশের নীচে কার্নিভ্যালকে নিয়ে আসার পরিকল্পনাটিও এক নারীর– তাঁর নাম রহনে ল্যাসলেট। ১৯৬৬ সালে নটিং হিল স্ট্রিটের উপর তিনিই এই উদযাপনকে এক অন্য মাত্রা দেন। তার পর থেকেই এই কার্নিভ্যাল আরও জনপ্রিয় হতে শুরু করে। শুধু ক্যারিবীয়রাই নন, ব্রিটেনে বসবাসরত সব জাতি, বর্ণের মানুষ এবং বিশ্বের নানা দেশের মানুষ যোগ দিতে শুরু করেন এই উৎসবে। এক সময় বর্ণবিদ্বেষের প্রতিবাদ হিসেবে শুরু হয়েছিল যে উৎসব, বুকের মধ্যে জমে থাকা অনুচ্চারিত ব্যথা, চোখের জল বেরিয়ে এসেছিল গান হয়ে, এখন সেই উৎসব আধুনিক, প্রাচুর্যে ভরপুর। ধীরে ধীরে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষে মানুষে মিলনের মেলা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ এক হয়ে সুর ও রঙের ভেলায় মিশে উদযাপিত হয় এই আনন্দ উৎসব– নটিং হিল কার্নিভ্যাল।
দশকের পর দশক পেরিয়ে আজও নটিং হিল কার্নিভ্যালের মূল সুরটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ ব্রিটেনে বর্ণবিদ্বেষ মোটেও মুছে যায়নি। বর্ণবিদ্বেষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামোফোবিয়া। “No black, no dog, no Irish” স্লোগান হয়তো শোনা যায় না, কিন্তু পথচারীর উদ্দেশে ছুড়ে দেয়া হয় ঘৃণায় মোড়া মন্তব্য– ‘নিগার’ বা ‘পাকি’। স্কুলে বৃটিশ শিশুদের সঙ্গে ক্লাস করতে গিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ বাচ্চাটিকে শুনতে হয় সে তাদের দলের নয় কারণ সে ‘ব্রাউনি’। একের পর এক ‘হেট ক্রাইম’এর জেরে প্রাণ হারান অশ্বেতাঙ্গ মানুষ, প্রকাশ্যে আসে উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারির খবর। দিন পাল্টেছে, মানসিকতায় কিন্তু খুব একটা বদল আসেনি। যে উৎসবের মাধ্যমে একদিন মানুষ বোঝাতে চেয়েছিল নিজেদের যন্ত্রণার কথা, সেই যন্ত্রণার ক্ষত মুছে যাবার বদলে প্রবাহিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। সেই ক্ষত থেকে আজও রক্ত ঝরে বলেই আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার অনুষঙ্গে ব্রিস্টলের ক্রীতদাস ব্যবসায়ীর মূর্তি টেনে নদীর জলে ফেলে দেওয়া হয়। নটিং হিল উৎসবের তাৎপর্য তাই আজও গভীর। কেবল দু দিনের হই হল্লা, আনন্দে মাতার উৎসব নয়, ক্যারিবীয়দের এই কার্নিভ্যাল হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার হওয়ার এক অভিনব আয়োজন।
গত বছর অগাস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে এই আনন্দ যজ্ঞে সামিল হয়েছিলাম। লন্ডন তখন ব্যস্ত গ্রীষ্মের শেষ দিনগুলিতে সূর্যালোকের উত্তাপ নিতে। আর নটিং হিল মেতে উঠেছে তার বাৎসরিক উৎসবে। সাড়ে তিন মাইল জায়গা জুড়ে যেন বসেছে রামধনুর হাট। বড় বড় গাড়ির উপর মঞ্চ সাজানো হয়েছে। রকমারি বাদ্যযন্ত্রের মেলা বসেছে। নানান রকমের সাউন্ড সিস্টেম। Reggae, Calypso, Rumba, Zouk মিউজিকের মূর্ছনায় শরীর আপনা থেকেই দুলে ওঠে, হাত পা গানের ছন্দ অনুসরণ করে চলে। প্রকৃতির যত রঙ আছে সব যেন কার্নিভ্যালের পোশাকে ঢেউ তুলেছে। জেনে আশ্চর্য হলাম, উৎসবের পোশাক পরিকল্পনার মধ্যেও বোনা রয়েছে প্রতিবাদের রঙ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন ফ্রেঞ্চ ক্যাথোলিকরা ত্রিনিদাদে পাড়ি দিয়েছিল, তখন তাদের ম্যাস্কারেড পার্টি বা বল ডান্স দেখে সেসবের অনুকরণ করত তাদের ক্রীতদাসীরা। ‘মনিব’দের সেই মাস্ক এর সঙ্গে মিশেছে ক্যারিবীয়দের নিজেদের উজ্জ্বল পোশাক, পালক ব্যবহার করার চল। চারিদিকে যেন রঙিন প্রজাপতিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে, দেখাদেখি আমারও সাধ হয় ডানা মেলে দিতে। অ্যাফ্রো-ক্যারিবিয়ান গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের মোহিনী নৃত্যের ছোঁয়া আপনা থেকেই সঞ্চারিত হয় লক্ষ লক্ষ দর্শকদের মধ্যে। নৃত্যের তালে পা মেলান সাহেব, মেমসাহেবরাও। ইউরোপ, আমেরিকা, চিন, আফ্রিকার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ জড়ো হয়েছেন কার্নিভ্যালে। নাচতে নাচতে খিদে পেয়ে গেলেও কোনো চিন্তা নেই। নাচ গানের সঙ্গেই রয়েছে খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজন। সুস্বাদু স্ট্রিট ফুডের গন্ধে চারদিক ভরপুর। বড় বড় ফুড ট্রাকের সামনে মানুষের লম্বা লাইন। কেউ ক্ষুধার্ত, কেউ বা ভোজনরসিক। ক্যারিবিয়ান ক্যুজিন– জার্ক চিকেন, অক্স টেইল স্যুপ, আকি (একধরণের ফল) অ্যান্ড সল্ট ফিশ, ক্যালালু (শাক সবজির ডিশ) গোট স্টুয়ের স্বাদ নিতে। খাবার দাবারের সঙ্গে রয়েছে নানান স্বাদের, নানান রঙের পানীয়ও।
খাওয়া দাওয়া সেরে টুক করে আবার মিশে গিয়েছিলাম কৃষ্ণকলিদের ভিড়ে। সাম্বার তালে তালে পা মিলিয়ে আমি মনে মনে গেয়ে উঠেছিলাম ‘আমরা শুনেছি ওই মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ… বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, ভা—ঙো।’
কোভিড-১৯ এর প্রকোপে ২০২০র নটিং হিল কার্নিভ্যাল এবার অনলাইনে। কীবোর্ডে আঙুল রেখে অনুষ্ঠানের সাইটে লগইন করতে করতে গত বছরের গ্রীষ্মে উজ্জ্বল উৎসবে মেতে ওঠার স্মৃতি ফিরে এলো। সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম এক অনন্য কার্নিভ্যালের কাহিনী।